Saturday 19 September 2020

যে জীবন ফড়িংয়ের

                  "যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা.." -জীবনানন্দ।
 
 
 

◆জলের দিকটাতে ছিপ ফেলে একদৃষ্টে চেয়ে থাকি একলা দুপুরটাতে।নির্জন পুকুরের জলের অনেকটা কাছ ঘেঁষে দুর্দান্ত উড়ে যায় হলুদ-লাল-সোনালী ফড়িঙের দল।তাদের উৎসাহী কয়েকটা ফাতনার ওপর এসে ছুক ছুক করে ,তারপর একটু ক্লান্তি জুড়িয়ে নিতে ডানা ছড়িয়ে বসে।
ছোট্ট একটা ছেলে কানের পাশ দিয়ে শো‌ঁ  করে কচি দুটো কচুপাতা দুহাতে ঢালের মত করে বাগিয়ে  ধরে, আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে মিলিয়ে যায় দূরে..।তখন আমিও ছোট্ট খুব।তাকে ধরতে চেয়ে চিৎকার করে জানতে চাই "কোথায় যাচ্ছো?" ক্ষীণ একটা সাড়া ভেসে আসে, "ফড়িং ধরতে..এ-এ.এ.এ."
                            এগিয়ে যাই। ঘনিয়ে আসা অন্ধকার পুকুর ঘাটের পাশটাতে ছড়ানো ঘাসের বন 
আর একফালি সবুজ মাঠ।সেখানটায় মাছ ধরার ছোট্ট জাল জোগাড় করে ফড়িং ধরার কৌশল করতে থাকে ওরা ।অভাগা যাদের জামায় একখান পকেট ছাড়া আর কিস্যু নেই,তারা পাতায় কিংবা হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে কচি ঘাসের আগায় বুক ফুলিয়ে বসে থাকা চংবং করা ফড়িংটাকে কব্জা করে ফেলে।তারপর "দেখ্ দেখ্ আমারটা নীল আর তোরটা রাজা ফড়িং,কেমন সবজে-কালো!" ওদের সবাই মারে না, কেউ কেউ বলে "ভগ্বান রাগ করবেন তাঁর জীব মারলে"।কেউ আবার আইন বাঁচিয়ে পেছনে একটা ঘাস কিংবা দড়ি লাগিয়ে ছেড়ে দেয়! দুটো ফড়িং মুখোমুখি এনে লাগিয়ে দেয় নারদ-নারদ।তারপর  আর কিছুক্ষনের তরে ওরাই হয়ে ওঠে তাদের খেলার সাথী।জাল কে জাল আর পাতা কে পাতা পড়ে রয়।সন্ধ্যা নেমে আসে ঝুপ করে।তখন যে ওরা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যায় কে জানে!পুকুরের জলে পড়ে রয় মলিন আকাশটা।ঘরমুখী হয় ছেলেমেয়েরা।উড়ু উড়ু ডানার এবার বিশ্রামের পালা।
             দাদু বলত, একঝাঁক মেঘ নিয়ে  আসে একঝাঁক ফড়িংএর এলোমেলো ওড়া।মাঝে মাঝে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হলে পরে ভিজে একসা হতে দেখা ফড়িং গুলোকে বেশ দেখেছি চনমনে রোদের  আলোয় সমান্তরালে উড়ে যেতে।সন্ধেতে হ্যারিকেনের আলোয় সহজ পাঠ পড়তে বসে আমি আর ভাই বিভ্রান্ত ফড়িং গুলোকে হাতে ধরে দেশলাই বাক্সে চালান দিয়ে তার ভোঁ-ভোঁ শব্দ শুনেছি বিভোর হয়ে।সকালে বেঁচে আছে কিনা দেখতে গিয়ে ফুড়ুৎ হয়ে গেলে,হতো আফসোস ।নির্বোধ গুলো বর্ষার দিনে পালা করে প্রায়ই আসতো দেখা করতে।রাতদুপুরে আলোর খোঁজে আসা কত্ত ফড়িং দেয়াল টিকটিকির খাবার হয়ে গেছে, কিংবা বাঁশপাতি-ফিঙের  ঠোঁটে বেমালুম মারা পড়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

                                            ফ এ ফড়িং
খাদ্যশৃঙ্খলের নিচের দিকে থাকা প্রাণী গুলো প্রতিমুহূর্তে যে সংকট আর অস্থিরতায় দিনযাপন করে তা আমাদের পক্ষ্যে কোনোদিনই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়।কোটি কোটি বছর ধরে এরা রয়েছে এই পৃথিবীর বুকে।  ডাইনোসর এর বিলুপ্তিসহ  অসংখ্য উত্থন পতনও এরা দেখে ফেলেছে। কিন্তু তাও কি অসম্ভব নীরবতা নিয়ে এই প্রকৃতিতে এখনও এদের বিচরণ।জীবনচক্র আর appearance এর বিচারে এদের ভিনগ্রহী প্রাণী বলে ভুল হওয়াটাও বিচিত্র কিছু নয়!সারা পৃথিবী জুড়ে Dragonfly/ফড়িং এর ৩০১২টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে এপর্যন্ত।মোটামুটি অ্যন্টার্কটিকা বাদে প্রায় সব মহাদেশেই এরা ছড়িয়ে রয়েছে।মূলত ক্রান্তীয় অঞ্চলে জলাভূমির পাশাপাশি এদের দেখা মেলে।তবে কিছু ক্ষত্রে মরু অঞ্চলে এবং higher altitude ও এদের পাওয়া যায়!তবে যতই উচ্ছতা ভেদে এদের প্রজাতির বৈচিত্র্য কমে আসে।

■মেয়ে ফড়িং জলের মধ্যে লেজ ডুবিয়ে  জলের মধ্যে ডিম পাড়ে।খুদে চালের মত ডিম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই nymph এ পরিণতি পায়।এই দশায় এরা জীবনচক্রের একটা গুরুত্বপূর্ন সময় (কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে প্রায় ২  বছর জলের নিচেই অতিবাহিত করে।সেসময় এদের খাদ্য তালিকায় থাকে ব্যাঙাচি, কচি মাছ কিংবা মশার লার্ভা।এই সময় দেখতে এতটাই অদ্ভুত রকমের হয়, মনে হবে যেন কোন  sci-fi গল্পের alien.এরপর জলের ওপর ধীরে ধীরে উঠে আসা। আর তারপর এক উড়ান ভরতে প্রুস্তুত এক তরতাজা প্রাণ।

◆শীতল রক্তের প্রাণী বলে(এদের অবশ্য রক্তের বদলে থাকে haemolymph) তাপমাত্রার নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি হয়ে পড়ে, তাই খুব উষ্ণ দিনে জলের খুব কাছ দিয়ে উড়ে গিয়ে , ডানায় জলের ছিটে নিয়ে কিংবা শীতল দিনে রোদ্রে প্রয়োজন মাফিক ডানা মেলে বিশ্রাম নেয়।

◆খাবার হিসেবে মশা,মৌমাছি, মথ, এমনকি অন্য প্রজাতির ফড়িংও খায়! নিজের এলাকা ধরে রাখতে এরা ভীষণ রকমের তৎপর থাকে।ফলে যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়তে হয় কখনও সখনও।

◆প্রজনন বড়ই বিচিত্র রকমের।অন্য পুরুষদের নিজ এলাকা থেকে তাড়িয়ে এরা নারীর পছন্দের পাত্র হয়ে উঠতে চায়। মিলনকালে এদের দেখতে অনেকটা wheel অথবা heart ,structure এর মত হয়।

★ সারা পৃথিবী জুড়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসছে জলাভূমির পরিমান।কমছে এদের সংখ্যা।এদের জীবনচক্রের একটা বিশেষ পর্যায় যেহেতু জলে কাটে আর জলের তাপমাত্রা, pH ইত্যাদি গুলোর ওপর ভীষণভাবে জীবনচক্রের নির্ভরশীল। তাই আমাদের ভাবতে হবে,এদের নিয়েও! আমরা অনেক কিছুই পারিনা, কিন্তু যা পেরেছি তার মধ্যে আছে রাসায়নিক সারের কৃষিজমিতে ব্যাপক ব্যবহার, ঘাস মারতে অযথা বিষপ্রয়োগে, জলের কচুরি পানা মারতে কীটনাশক।আর জলা জায়গা তো কমছেই!এগুলো কি একটু সাধারণ প্রচেষ্টা দিয়ে বন্ধ করা যায়না!আমরা কি পারব পরবর্তী প্রজন্ম কে ফড়িং নিয়ে খেলতে দেখে যেতে!জানি না!উত্তর নেই।
©ছবিগুলো সব বাড়ির আশেপাশে তোলা।