শীতকাল আমার ভীষণ প্রিয়। কেন যে এমনতর ভালোবাসা জানিনা। কোনো শীতের রাত্রে, পৌষালী হাওয়ার হিমেল আবেশে ভেসে ভেসে আমার আগমন বার্তাটি এনে দিয়েছিল বাড়ির লোকজনের কাছে। সে প্রায় আঠারো বছর আগের কথা। ছোটবেলায় নাকি আমাকে বিশেষ করে শীতকালে সর্ষের তেল মর্দন করে ফেলে রাখা হত উঠোনে। সেই থেকে সোনালী রোদের সাথে আমার সখ্যতা। এ বিষয়ে আমার অনুজও কম জাননা। সূর্যিমামার ওপর একক অগ্রাধিকার সইতে না পেরে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনিও ভূমিষ্ঠ হলেন এই ধরাধামে। রৌদ্রকরোজ্জল দিন গুলিতে সেদিন থেকে তিনিই হলেন আমার খেলার সাথী। সে যাইহোক, অনুজের কিন্তু শীতকালটি একদমই উপাদেয় নয়।কারণ শীতকালীন ঝঞ্ঝা ; অর্থাৎ সর্দি কাশি ইনার ওপর সেই সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে শুরু করে এখনো স্বমহিমায় বিদ্যমান। এবুঝি আমার শীতকাতুরে ভালোবাসায় ভাগবসানোর জন্য সূর্যিদেবের শীতল অভিশাপ।ফিরে আসি মূল কথায়। সেই যে রোদ্রে পুড়ে সোনার মত খাঁটি হলাম, তাই থেকে শীতের সাথে আমার অবৈধ ভালোবাসা। অবশ্যই ভালোবাসি বলে এই নয় যে বুকে বেঁধে রাখি! সোয়েটার, হনুমান, টুপি, দস্তানা, মোজা সবই থাকে আমাদের মাঝে।
বেশ মনে পড়ে কিশলয় এর সেই ছড়া “উঃ আঃ কেন কর, শীত লাগে তো গানটি ধরো” শীতের কবলে পড়ে গান ধরার মত দ্বিতীয় টোটকা বোধকরি ইহজগতে আর দ্বিতীয়টি নেই। যত শীত তত জোরে গান।তখন ভোরে ওঠার অভ্যেস ছিল। এগুন আমার পিতামহের থেকে প্রাপ্ত।কতটা জাত কষ্টসহিষ্ণু হলে পরে লেপ কম্বলের মায়া ত্যাগ করা যায় সেকথার খোঁজ রেখেই বা কজনা।তবে যদি এককাপ bed tea পাওয়া যায় তখন শীত বেটা বেমালুম উধাও হয়ে যায়। মনে হয় যেন গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় এসে গেছি। খড় দিয়ে আগুন পোহানো হত ।সবচেয়ে যে সমস্যাটা ছিল সেটা হলো যতক্ষণ আগুন ততক্ষণ আরাম। তারপর যে কে সেই। কখনও দাদু বিছানা থেকে তুলে দিয়ে চলে গেলন। ব্যাস! লেপের ভেতর আবার ঢুকে দে ঘুম। যতক্ষণ না মা-জননীরচিল চিৎকারে বাড়ি মাথায় উঠত, ততক্ষণ কি অনুপম স্বর্গসুখ বিরাজ করত ঘুমঘোরে।
শীতের ফুলকপি খেতে কি ভালোটাই না লাগতো। মা তরিতরকারির খাতিরে সেদ্ধ ফুলকপি নুন তেলে ছেঁকে থালায় তুলে রেখে যেইনা অন্যমনস্ক হয়েছেন অমনি দু তিন পিস গপাগপ ভ্যানিশ। এজন্য কম বেগ পেতে হয়নি!অনেকবার লোভের চোটে যেইনা গরম জিনিসটা চালান দিয়েছি অমনি জিভের পো পুড়ে একশা কান্ড।মনখুলে চিৎকারও করতে পারিনে। চুরির মাল কিনা!ধরা পড়লে আর রক্ষে আছে। মাঝে মাঝে অসাবধানতা বসত ধরা পড়ে গিয়েছি থালার ঝঞ্ঝনানিতে তে। কিন্তু চুরিতে ভাটা পড়েনি কোনো দিন।
যখন ধান তোলা হত মাঠ থেকে তখন আরেক মজা।দাদুর সাথে যেতাম লক্ষ্মী ঠাকুর আনতে। দাদু মাথায় নেবেন আর আমি চলবে সামনে জলের ছড়ি দিতে দিতে। আর ছোটভাই চলবে ধেই ধেই করে নেত্য করতে করতে।শুধু বলবে “আমায় দাও আমায় দাও। আমিও মাথায় নেব” শাঁখ বাজানোয় আমি পারদর্শী ছিলাম।অগত্যা পথিমধ্যে সেই দায়িত্ব মাঝে মাঝে বন্টন করে নিতে হতো।…ধানঝাড়াইএর সময় তেমন মজা না থাকলেও ঝাড়াই করা খড় নিয়ে অনেক স্মৃতি আছে।ঝাড়াই করা খড় চাই করে ফেলা হত খামারে । পাড়ার সমবসয়সী ছেলেমেয়েদের আমদানি হত সেখানে।চলত ডিগবাজি দিয়ে গড়িয়ে পড়া, মারপিঠ,হইহুল্লোড়, হরেক রকমের কসরত । সর্বোপরি খড় সাজিয়ে চৌকো খোপ বানিয়ে লুকোচুরি খেলা।মাঠ থেকে ধান উঠে গেলে সেখানে পিচ করে মাসের পর মাস ব্যাট পেটানো।
সবচেয়ে বড় পাওনা ছিল শিউলি আর সিতাহরণের ফুল। এত সুগন্ধি ফুলগুলো চন্দ্রালোকিত বনজ্যোৎস্নায় যখন ওই পথ দিয়ে হাঁটা দিতাম কেমন করে যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়তাম। সকালের ঘাস বিছানো রাস্তায় সাদা হয়ে পড়ে রইতো শেষ রাতের ঝরাফুলগুলো।সঙ্গে করে ম ম করা সুবাসে ভরপুর চতুর্দিক। আহঃ কি অনন্য সেই অনুভূতি। অতঃপর শীত যখন এসেই পড়ে তখন বসন্তের আর অপেক্ষা কিসের!
(২৭শে নভেম্বর, ২০১৬)
◆আপাতত এই অব্দি বলে আমার diary থেমে গেছে।একদিন সময় পেলে HRI এর দিন গুলো নিয়েও লিখব।আর ছবিটা ©"শ্রীতমা" দির থেকে অনুমতি নিয়ে নেওয়া। এখানের দিনগুলোর সাথে ওই দিনগুলো কেমন যেন ওই ছবিটা দিয়ে জোড়া!
No comments:
Post a Comment