বেলা পড়ে আসছে। গেস্ট হাউসের ৩০৫ নম্বর ঘরের স্বচ্ছ কাচের জানালা দিয়ে বিকেলের এককুচি রোদ এলিয়ে পড়েছে আড়াআড়ি করে উঠোনের ওপরে ।চেয়ারটায় বসে তার মিঠে আদরের স্পর্শসুখ মোটেই মন্দ ঠেকছে না। অফিস-কাঁচারী-ক্লাস রুম-মেশ-মেশিন হইহুল্লোড়ি ভাবভঙ্গীর ঠিক বিপরীতে, ঠাট-বাটহীন অনাড়ম্বর ছন্দে গাঁথা এরকম একখানি নির্জন প্রেক্ষাপট ঠিক কবে থেকে আমার তরে সাজানো ছবি হয়ে ঠায় দাঁড়িয়েছিল ছিল জানা নেই! দিনান্তের এই লাল সূর্যমাখা আকাশের নীচে একফালি সবুজ ঘাসের লন ।তার ওপর ক্ষণে ক্ষণে যে কত নগন্য সবগল্পের বুনন চলছে অজ্ঞাতসারে, তার হদিশ নেই কারুর কাছেই।ওই তো ওর ওপরই ঝগরুটে ছাতারের দল রাজত্ব করে বেড়িয়ে গেল সন্ধ্যেবধি। শীর্ণ পেয়ারা গাছের ছায়ার অন্দরে কাঠবেড়ালির চঞ্চলখেলায় জমে উঠলো ভরদুপুর।তারই মাঝে মাঝে নিত্য অবসরে পুঁচকে দোয়েল পাখি এডাল-ওডাল করে, জমানো কথা হাঁকিয়ে চলে গেল বেশ। ল্যাজচেরা জাঁদরেল ফিঙে খানদানি style এ এসে ফাঁকা চেয়ার গুলোর ওপর বসে, এদিক ওদিক খানিক নিরীক্ষণ করেও কোন শত্রুর ঠিকানা না পেয়ে নিরাশ ভাব নিয়ে উড়ে চলল..। সবজে টিয়ারা সদলবলে পেয়ারা গাছের ওপর বসে একে অপরকে খিস্তি খেউড় করে বেমালুম উবে গেল যেন..। তারই ফাঁকে নির্জনতার সুযোগ নিয়ে একজোড়া common quail এসে চুটিয়ে প্রেম করে যায় রোজ। এদিকে ইতিউতি মালির নিপুন হাতে গড়া পাতাবাহারি গাছ সুচারু ভাবে ছাঁটা।সেই সাথে কিছু সাদা করবীর ফুল ফুটে আছে কবে থেকে! পাশেই snake plant এর টব।তার ওপারে কোন অনাগত অতিথির জন্যে পাতা কিছু বেতের গার্ডেন চেয়ার-টেবিল অবহেলায় পড়ে থাকবে আরও কিছুদিন। ওদের একাকিত্বে দিগন্ত আড়াল করে রাখা কৃষ্ণচূড়া-রাধাচূড়ার হলুদ-লাল ফুল স্বস্তি দেবে খুব। সেই গাছেদের সারির ওপারে ভালো করে দেখলে পরে বোঝা যায় হঠাৎ করে উপত্যকার মত নেমে যাওয়া ভূমিরূপের বঙ্কিম খেয়ালী ভাব। সেখানের শুকনো ঝোপের আড়ালে-আবডালে লাজুক শেয়ালের দল ঘুরে বেড়ায়,কখনওবা হাঁক দিয়ে যায় সন্ধ্যা প্রহরে।এসব ছাড়িয়ে দূরের দিকে তাকালে যেন মনে হয়,সবুজ শ্যামলীমা মাটির মমত্ব ছাড়িয়ে আকাশের অনন্ত সুনীল দিকশূন্য উপাখ্যানের পানে ধেয়ে না চুমে অব্দি ক্ষান্ত হয়নি।হয়ত ওর ওপরেই অদৃশ্য পর্দার আড়ালে চিরায়ত গঙ্গা বহমান। তার আর্দ্রতার আভাস যেন মিহি অতরগন্ধী মোহের আতিশয্যে বুঁদ করে রেখেছে চারপাশ। পৃথিবীর সব আলো স্তিমিত হয়ে আসে তার রেশে।তবুও চিরাচরিত গল্পের মত এখানে দূরে কোন গ্রাম নেই, যেখানে জ্বলে উঠবে সন্ধ্যা প্রদীপের আবেশ।নিঝুম বনপথের অন্দরে-কোন্দরে শ্বাপদের রাজত্বের গাঢ় আধার যেভাবে ঝুপ করে নেমে আসে নিয়ম করে রোজ,কোনো মতেই তার অন্যথা হওয়ার জো নেই। সেই কুহকের আড়ালে চলে ভিন্ন যুগের ভিন্ন কালের মায়াবী রাজত্ব । সীমান্ত কাঁপানো অভ্রভেদী উদ্দাম ঘোড়ার মত মত্ত বাতাস এসে গায়ে লাগে। অপ্রকৃতিস্থ-অতিপ্রাকৃত-অতিপ্রাচীন ভাব যেন ঘিরে ধরে চারদিক। পরাজয়ের সন্ধি হিসেবে পৃথিবীর সব আলো যেন ফিরে যাচ্ছে , পেছনে পড়ে থাকে পুরু অন্ধকারের পাড়।সেই সঙ্গে ঝিঝি সাঁঝপাখির বরাভয় ডাক দিয়ে আদিমতম রাজত্বের সূচনা হচ্ছে। পাতায় পাতায় মর্মরিয়ে ওঠা উলু ধ্বনি যেন তারই আভাস। মানুষেরও বহু আগে থেকে ঘটে আসা সেই পদধ্বনি যেন তাদেরই সারা রাতের আয়োজন।
পুনশ্চ: এই ছিল আমার আজকের ডায়রী। HRI তে বসে।সাতদিন হল নিভৃতবাসে আছি। কঠিন সময়ের মাঝে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কঠিন হাত,মানুষের প্রতি মানুষের সাহায্যের হাত বাড়ানোর বন্ধুতা গুলো চিনে নিতে পারা কম উপলব্ধি নয়! শুধু যার ওপর ভর করেই মানুষের আরও হাজার বছর ঠেকায় কে! এই যে বিশ্বাসের ভূমি তারই কয়েকটা স্টেশন এর নাম অদিতি ,থাঙ্গা ,প্রজাপতি, বানওয়ারীসহ কোটি কোটি মানুষ যাদের নামও হয়ত জানব না কেউ ,তাদের জন্যে করোনা কেন আরও ভীষণ মহামারীও হারবে। হারতে বাধ্য। সবাই সবার হাত ধরুন।
সবশেষে এই গানটা:-
"বল কি তোমার ক্ষতি
জীবনের অথৈ নদী
পার হয় তোমাকে ধরে
দুর্বল মানুষ যদি"
স্থান: HRI- Guest House, ৩০ শে এপ্রিল,২০২১,
ছবি: এলাহাবাদী গঙ্গার।
No comments:
Post a Comment